বইয়ের ঘরের আলাপ-চারিতা

Mar 03, 2018

একটা সময ছিল যখন মানুষ নিজের মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করেছে।হাতের কাছে যা পেয়েছে তাতেই লিপিবদ্ধ করতে চেয়েছে নিজের না বলা কথাগুলোকে।পাহাড়ের গুহা থেকে যার শুরু তা এখন কমপিউটারের দখলে।তখন লেখার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহ্রত হত বিভিন্ন প্রকারের প্রাকৃতিক বস্তু ;যেমন পাথর,হাড় বা কাঠ।সভ্যতার ছোঁয়ায় যখন আস্তে আস্তে মানুষ আলোকিত হতে শুরু করল তখনই অনুভব করল তার বর্তমান জ্ঞানকে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য সংরক্ষন করা প্রয়োজন, ব্যাস শুরু হয়ে গেল বই লেখার চেষ্টা। সামাজিক প্রয়োজনে এবং প্রযুক্তির নিত্যনতুন উদ্ভাবনে বইয়ের আকার-আকৃতিতে ঘটে চলছে নাটকীয় পরিবর্তন। চিরায়ত বই আর ডিজিটাল বইয়ের মধ্যে চলছে টিকে থাকার লড়াই।বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় ডিজিটাল রথে চড়ে বই চলে এসেছে Clay Tablet থেকে Tablet pc তে । বই এককভাবে একটি বস্তু।এমন বস্তু যা দেখলে একটু নেড়েচেড়ে দেখতে ইচ্ছে করে।যে পড়তে জানে না,সেও পড়তে না পারার দু:খ মনে নিয়ে গভীর আগ্রহে উল্টেপাল্টে দেখে।অন্ত:ত বইয়ের ছবি দেখে সাধ মেটায়।

 

 

এ প্রসঙ্গে একটি সত্য ঘটনা প্রচলিত আছে ,আর তা হলো – ইংরেজ কবি কিটস্ গ্রীক ভাষা জানতেন না।কিন্তু তিনি জানতেন যে,গ্রীক সাহিত্যের একজন বিখ্যাত কবি হচ্ছেন হোমার।কবি কীটস্ -এর মনে প্রচন্ড আক্ষেপ ছিল তিনি হোমারের কোন লেখা পড়তে পারেননি বলে।কারন,তখন পর্যন্ত হোমারের কোন লেখার ইংরেজি অনুবাদ কীটস্ পাননি।এক সন্ধ্যায় কবি তার বন্ধুর বাড়ি বেড়াতে গিয়ে হোমারের বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ দেখতে পেলেন।বইটি হাতে নিয়ে কীটস্ এত আনন্দিত হলেন যে,তিনি আর একমুহূর্ত বন্ধুর বাড়িতে থাকতে চাইলেন না।কিন্তু সেসময় বাইরে প্রচন্ড ঝড় ও তুষারপাত শুরু হয়েছে।তাঁর বন্ধুতো কিছুতেই সেই অবস্থায় তাকে বের হতে দিবেন না।কিন্তু কে শোনে কার কথা!বইটি পড়ার জন্য যেন কীটসের ত্বর আর সইছেনা।অনেক অনরোধেও যখন কাজ হলোনাতখন একটুখানি অপেক্ষা করার কথা বলে বন্ধুটি ভেতরে গেলেন কীটস্ এর জন্য একটি রেইনকোট আনতে।ফিরে এসে দেখেন ঘর খালি,কীটস্ চলে গেছেন।বন্ধুটি মহা চিন্তায় পড়ে গেলেন আর নানা রকম আশংকা নিয়ে ভোর হওয়ার অপেক্ষায় বসে রইলেন এবং মোটামুটি নিশ্চিত যে,প্রলয়ংকারী এই ঝড়ের কবলে পড়ে রাস্তায় মরে পরে থাকবেন কীটস্।পরদিন খুব সকালে রাস্তার দু’পাশ দেখতে দেখতে বন্ধুটি যাচ্ছিলেন – কোথাও কীটস্ মৃতদেহ পড়ে আছে কিনা !পুরোটা পথ এভাবে পাড়ি দিয়ে এসে দেখতে পেলেন জলজ্যান্ত কীটস্ তখনো বসে বসে হোমারের বইটি পড়ছেন।বন্ধুটি অবাক হয়ে জানতে চাইলেন , এ কেমন করে সম্ভব হল।কীটস্ জানালো –“ এ এমন এক উন্মত্ত আনন্দ ,যা সব কিছুকে হার মানিয়ে দেয়।” অর্থ্যাত প্রিয় বইয়ের কাছে সব বাধাই তুচ্ছ।

বইয়ের ঘরকে বলা হয় গ্রন্থাগার অর্থাত লাইব্রেরি। গ্রন্থাগার শব্দটি বাংলা হওয়া স্বত্বেও কেন যেন এই শব্দটি বাংলা ভাষার সংগে অতটা মিশে যেতে পারেনি ,যতটা পেরেছে ইংরেজি শব্দ লাইব্রেরি।লাইব্রেরি বললে আমাদের চোখের সামনে যে ছবিটি ভেসে ওঠে গ্রন্থাগার বললে তাতে যেন একটু ছন্দপতন হয়!

লাইব্রেরিতে বই থাকে তা আমরা সবাই জানি ,কিন্তুু আমরা অনেকেই জানি না ,একটা বইকে কতগুলো স্তর পেরিয়ে তবেই পাঠকের কাছে পৌঁছাতে হয়।প্রকৃত লাইব্রেরি সম্পর্কে ধারনা না থাকার দরুন অনেকেই আবার বইয়ের দোকানকে লাইব্রেরি বলে থাকেন ,যা একেবারেই ভ’ল।বইয়ের দোকান আর লাইব্রেরির মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে।একসঙ্গে অনেকগুলো বই সাজিয়ে রাখলেই তা কখনো লাইব্রেরি হয় না।বই যতক্ষন দোকানে থাকে এবং অর্থের বিনিময়ে ক্রয় করতে হয় ,ততক্ষন পর্যন্ত অন্যান্য পন্যসামগ্রির সঙ্গে তার কোন পার্থক্য নেই।কিন্তু লাইব্রেরিতে বই রাখতে হলে তা হতে হবে বিজ্ঞানসম্মত এবং বিশেষ পদ্ধতিতে শ্রেণিবদ্ধ।

 

 

মেলভিল ডিউই নামক একজন মার্কিণ গণিতবিদ ১৮৭৬ সালে লাইব্র্রেরিতে বই সাজানোর বিজ্ঞানসম্মত একটি পদ্ধতি প্রনয়ন করেন যা ডিডিসি নামে পরিচিত।তিনি সমগ্র জ্ঞানকে মূল ৯টি ভাগে ভাগ করেছেন এবং একটি অতিরিক্ত ভাগ জুড়ে দিয়েছেন সাধারন জ্ঞান শ্রেণির জন্য।জ্ঞান বা বিষয় বিভাজনের প্রতিক হিসেবে তিনি গাণিতিক সংখ্যা ব্যবহার করেছেন ,যেমন –

  • ০০০ সাধারন জ্ঞান
  • ১০০ দর্শন শাস্ত্র
  • ৩২০ রাষ্ট্রবিজ্ঞান
  • ৩৩০ অর্থনীতি
  • ২০০ ধর্মীয়
  • ৩৭০ শিক্ষা
  • ৩০০ সমাজবিজ্ঞান
  • ৩৯৮.২১ রুপকথা
  • ৪০০ ভাষা
  • ৮২০ সাহিত্য
  • ৫০০ বিজ্ঞান
  • ৮৯১.৪৪১ বাংলা কবিতা
  • ৬০০ কারিগরি জ্ঞান
  • ৮৯১.৪৪২ বাংলা নাটক
  • ৭০০ চারুকলা ও চিত্তবিনোদন
  • ৮৯১.৪৪৩ বাংলা উপন্যাস
  • ৮০০ সাহিত্য
  • ৮৯১.৪৪০ বাংলা ছোটগল্প
  • ৯০০ ইতিহাস
  • ৯১০ ভ’গোল
  • ৯২০ জীবনী গ্রন্থ

একটি লাইব্রেরিকে সংগঠিত করার প্রাথমিক কাজ হলো প্রয়োজনীয় বইয়ের তালিকা তৈরী করে ক্রয়ের ব্যবস্থা গ্রহন করা এবং তালিকা মিলিয়ে তা বুঝে নেয়া।এক্ষেত্রে যাচাই করতে হবে বইয়ের বাঁধাই ,মূল্য ইত্যাদি ঠিক আছে কিনা।তারপর বইয়ের নির্দিষ্ট পাতায় প্রতিষ্ঠানের সীল দিয়ে একটি রেজিষ্টারে এন্ট্রি করতে হবে।আলাদা আলাদাভাবে প্রত্যেকটি বইয়ের সিরিয়াল নাম্বার ধরে বইয়ের জন্ম-বৃত্তান্ত অর্থাত বইটি এন্ট্রি করার তারিখ,সিরিয়াল নম্বর বা সংযোজন নম্বর ,লেখকের নাম,বইয়ের নাম বা শিরোনাম ,বইটি কোন প্রকাশনা সংস্থা প্রকাশ করেছে তার নাম,কোথা থেকে প্রকাশিত হয়েছে সে ঠিকানা,বইটির কতোটি সংষ্করন বের হয়েছে,কোন কোন সনে বের হয়েছে, বইটি কেনা হয়েছে না অনুদানে পাওয়া,অনুদান হলে কে বা কোন্ প্রতিষ্ঠান অনুদান দিয়েছে,বইটির মূল্য কতো – ইত্যাদি সব লিখে রাখতে হয়।একটি বইয়ের সংস্করন থেকে ওই বইটির কাটতি বা চাহিদা সম্পর্কে ধারনা পাওয়া যায়।সন উল্লেখ থাকলে অনেকদিন পর জানতে চাইলেও জানা যায় কোন্ সালে বইটির চাহিদা কেমন ছিল।এই যে,বইয়ের তথ্য-সংবলিত রেজিষ্টার খাতা,এই খাতাটিকে এক্সেশন রেজিষ্টার বলে আর এই রেজিষ্টারই হচ্ছে একটি লাইব্রেরির প্রাণস্বরুপ।এক নজরে এই রেজিষ্টার দেখে বলা যায় লাইব্রেরিতে কতোগুলো বই আছে।যদি কখনো কোন লাইব্রেরিতে আগুন লাগে বা অন্য কোন দূর্ঘটনা ঘটে তাহলে ,এই রেজিষ্টার খাতা রক্ষা করতে পারলে জানা সম্ভব হয় সংগ্রহের কতোটা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।কারন বইয়ের সিরিয়াল নম্বর থেকে জানা যায় লাইব্রেরিতে কতোগুলো বই ছিল।
রেজিষ্টার খাতায় এন্ট্রির পর বইয়ের স্পাইন বা শিরদাঁড়ায় একটি স্টিকারের লাগানো হয় যাতে একটি নম্বর দেয়া হয় ,একে কল নম্বর বা ডাকসংখ্যা বলা হয়।এই কল নম্বর বা ডাকসংখ্যা লেখার নিয়ম হলো -বিষয়ের শ্রেণীবিন্যাস সংখ্যা, লেখকের নামের প্রথম এক বা দুঅক্ষর ও বইয়ের নামের বা শিরোনামের এক অক্ষর নিয়ে লেখা।যেমন- রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্পর্কিত বইয়ের লেখক হচ্ছেন আব্দুর রহিম।বর্নিত জ্ঞানের বিভাজন অনুযায়ি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের নম্বও হলো ৩২০।লেখকের নামের প্রথম
দুঅক্ষর – আব এবং বইয়ের নামের প্রথম অক্ষর -রা ,এক্ষেত্রে বইটির কল নম্বর হবে (৩২০ / আব রা) ।বইয়ের গায়ে কল নাম্বার বসিয়ে তা নির্দিষ্ট সেলফে রাখা হয়।অনেক সময় ছোট-খাটো বা স্কুল লাইব্রেরি গুলোর বইয়ে কল নাম্বার দেয়া সম্ভব নাও হতে পারে।কারন ,লাইব্রেরির সম্পুর্ন নিয়ম পদ্ধতি পালন করতে হলে যে জনশক্তির দরকার তা আমাদের দেশের অধিকাংশ লাইব্রেরিতেই নেই।

লাইব্রেরিতে অনেক ধরনের বইপত্র বা ডকুমেন্ট আসে যেগুলো হয়তো সাময়িকভাবে গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে নয়,এ সকল উপকরন সমুহ এন্ট্রি বা ক্যাটালগ না করে শুধুমাত্র সিল দিয়ে কোন একটি বক্সে কিছু দিনের জন্য রাখা যেতে পারে,একে রিসোর্স বক্স বলা হয়।সাধারনত লিফলেট,ব্রোশিওর,বার্ষিক প্রতিবেদন,বুকলেট,নিউজ লেটার ইত্যাদি এই রিসোর্স বক্সে রাখা হয়।প্রতিটি রিসোর্স বক্সের গায়ে বিষয়বস্তু লিখে রাখলে প্রয়োজনের সময় খুঁজে পেতে সুবিধা হয়।একটি নির্দিষ্ট সময়ানেÍ এই রিসোর্স বক্স আপডেট করা প্রয়োজন।খেয়াল রাখতে হবে ,লাইব্রেরিতে বইপত্র সংগ্রহ করার মতোই একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো অপ্রয়োজনীয় বইপত্র বা ডকুমেন্ট সনাক্ত করে তা বাতিল করা।

নতুন আসা বইপত্র বা ডকুমেন্ট সম্পর্কে পাঠকদের নিয়মিতভাবে অবহিত করা দরকার।এতে লাইব্রেরির সঙ্গে পাঠকদের যোগাযোগ বাড়ে।এর জন্য একটি নোটিশ বোর্ডে নতুন আসা বইয়ের কাভার ও সুচিপত্রের ফটোকপি লাগানো যেতে পারে অথবা একটি তালিকা তৈরী করে ফাইলে রাখা যেতে পারে যাতে পাঠকরা ইচ্ছে করলেই নতুন সংগ্রহ সম্পর্কে জানতে পারেন।

লাইব্রেরির নিয়মিত পাঠকদের বা সদস্যদের নামে বই ইস্যু করার জন্য একটি রেজিস্টার খাতা ব্যবহার করতে হবে।এই কাজটি কম্পিউটারে করতে পারলে ভালো ,কম্পিউটার না থাকলে রেজিষ্টারেই রেকর্ড রাখা যেতে পারে।এ ক্ষেত্রে রেজিষ্টারে যে তথ্যগুলো থাকা প্রয়োজন ,তা হলো – ক্রমিক নাম্বার , পাঠকের নাম , সদস্য নাম্বার ,ইস্যু তারিখ , বইয়ের নাম, পাঠকের স্বাক্ষর, ফেরত দেয়ার তারিখ এবং বই সরবরাহকারীর স্বাক্ষর।

 

.

Comments